বাক্‌ ১১৫ | বঙ্কিমচন্দ্র | অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত




দ্বাদশ পর্ব
কথোপকথন/১ 
ঋত্বিক-নবারুণ কথোপকথন

‘এ ম্যান ক্যান বি ডেস্ট্রয়েড বাট নট ডিফিটেড’
‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’—আর্নেস্ট হেমিংওয়ে


ছবিঃ লেখক

ঋত্বিকঃ একটা মন্দির স্থাপন করে তার পেছনে একটা মিথ্যে গপ্পো না ফাঁদলে তো লোককে টানা যায় না। সেটাই হয়েছে। সেজন্যেই একটা গল্প তৈরি করা হয়েছে। একটা গুল তৈরি না করলে পুরুতদের জমে না তো। তবে রাস্তার লড়াইটা রাস্তাতেই হবে। তার জন্যে রাস্তা অবধি যেতে হবে আমাদের, যেতে হবে সর্বোচ্চ এবং পূর্ণ শক্তি নিয়ে। 

নবারুণঃ আপনার সাথে আমার পার্থক্যের জায়গাটা কোথায় জানেন, আপনার সাথে না বলে আপনার সময়ের সাথে আমার সময়ের বলা উচিত... সেটা হল, আপনি তিতাস সিনেমায় নদী শুকিয়ে হারিয়ে যাবার পরে, জেলেদের গ্রামটা শেষ হয়ে যাবার পরে, নদীর চরে একটা ধানক্ষেত দেখাতে পেরেছিলেন। এটা তো মূল উপন্যাসটায় ছিল না। আপনি নিজে এই আশাটা দেখতে পেয়েছিলেন যে, মানুষ অমর, ইন্ডিভিজুয়াল মানুষ মরণশীল, কিন্তু মানুষ অমর... একটা ধাপ পেরিয়ে সে আরেকটা ধাপে গিয়ে দাঁড়ায়। সভ্যতা কখনও মরে না, সভ্যতা পালটায়। আমি সেটা দেখতে পারি নাএই আশার জায়গাটা আমার নেই। তাই আমার খেলনা নগর যেখানে সুপরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় একটা জায়গার জনজাতিকে শেষ করে দেওয়া হয়... এমনভাবে শেষ করা হয় যাতে ওই জায়গায় ভবিষ্যতে আর কেউ নতুন করে থাকতে না পারে... একটা পরিত্যক্ত জায়গা হয়ে যায়... তো, সেই জায়গাটা ধ্বংস হয়ে যাবার পর, আমাকেও উপন্যাস শেষ করতে হয়। আপনার তো একটা দাঁড়াবার জায়গা ছিল। যেটা ওই নদীর ভেসে ওঠা চর। সেখানে নতুন রসদও ছিল। সেটা ওই চরে তৈরি হওয়া নতুন ধানক্ষেত। আমার এসব কিছু নেই।

ঋত্বিকঃ রাইট... আটারলি রাইট... কিন্তু কেন? কেন এরকমটা হল? এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না... দু বাংলার নাড়ি কেটে গেছে এটা তো দেখার কথা ছিল না... এমনকি যাদবপুরে ওই জায়গায় মাটিতে পুঁতে রাখা রাইফেলগুলোর ওপরে ফ্ল্যাট উঠে গেছে এটাও তো রণজয়ের দেখার কথা ছিল না...

নবারুণঃ আমি জানি না... একেবারেই জানি না...

ঋত্বিকঃ একটা জিনিস দ্যাখো... যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তোমার রণজয়... সে তো এই সময়টায় তার শরীরটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে... কিন্তু তার চেতনা, স্মৃতি, বিচার, বুদ্ধি, তার যুক্তি সব আবর্তিত হচ্ছে ওই সত্তর সালে... যুদ্ধের সময়টায়... ব্যাটল ফিল্ডে... রণজয় জানে, বিশ্বাস করে এবং পূর্ণ মাত্রায় বোঝে যে সে রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছে... অথচ তার হাতে রাইফেল নেই.. অস্ত্র নেই কোনও। কী করবে? সে যাদবপুরে যায়, খুঁজে খুঁজে ঠিক সেই জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছায় যেখানে তারা কতগুলো রাইফেল পুঁতে রেখেছিল। কিন্তু এখন গিয়ে দ্যাখে সেখানে ফ্ল্যাট উঠে গেছে। উঁচু একটা বাড়ির ভিতের নিচে চাপা পড়ে গেছে যুদ্ধের সব অস্ত্রশস্ত্র। এই যে গ্যাপটা.. এই যে হারিয়ে যাওয়া লিঙ্কটা... কী করে এটা হল... এটা রণজয় বুঝে উঠতে পারে না। ...ইতিহাস ধরে হেঁটে এসেই আমি উপলব্ধি করেছি যে মানুষ অমর। সভ্যতা মরে না। তুমি অথবা রণজয়.. তোমরা দুজনেও ইতিহাস ধরেই হাঁটছিলে... কিন্তু মাঝখানে একটা লিঙ্ক কেটে গেছে... ঐ মাঝখানটাতেই সব পালটে গেছে।

আরও একটা জিনিস... এখন বলতে বলতে মনে হল... রণজয়ের মতো এই ব্যাপারটা... মানে ইতিহাসের একটা সময়ে চেতনার থেমে যাওয়া... আশপাশের সময় এগিয়ে গেছে.. নিজের শরীর এগিয়ে গেছে তার বয়েস নিয়ে.. সন্দীপনের একটা লেখায় ছিল না? যে লোকটা ম্যারাথনে দৌড়চ্ছে, তার সঙ্গে তার বয়েসও দৌড়চ্ছে...রণজয়ের মনটা কিন্তু তিরিশ বছর আগের সময়টায় রয়ে গেছে... এটা আমারও ছিল... আমি ভেবেছিলাম, দুই বাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মিল না হোক সাংস্কৃতিক মিলটা হবেই... দুজনের সংস্কৃতি এক। কিন্তু বাহাত্তরে যখন বাংলাদেশ গেলাম... একুশে ফেব্রুয়ারি... প্লেনে করে গেছিলাম... আমার পাশে সত্যজিৎবাবু বসে... পদ্মার ওপর দিয়ে যখন প্লেনটা যাচ্ছে আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম... সেখানে গিয়ে দেখলাম তো সব পালটে গেছে। কিস্যু নেই। দুই বাংলার সব নাড়ি কেটে গেছে। তারপরে আমি তিতাস করলাম সেখানে। তখন আমাকে নদীর ওপরে ওই চর আর ধানক্ষেতটা দিতে হলনইলে আমাকে স্যুইসাইড করতে হত।

নবারুণঃ সেই মিসিং লিঙ্কটাকে পূরণ করার জন্যেই কি তাহলে আমাকে ফ্যাতাড়ুদের আনতে হয়? হতে পারে... মে বি... মানুষের একটা তো দাঁড়াবার জায়গা... কিছু একটা তো দরকার যেটা সে কামড়ে দাঁড়াবে... আমার সময় সেটা আমাকে দেয়নি... র‌্যাদার দিতে পারেনি। তাই কাঙাল মালসাটে একটা কাল্পনিক যুদ্ধ আমাকে লড়তে হয়... যে যুদ্ধটা হোক আমি চেয়েছিলাম.. কিন্তু হবে না... ফলে সেটা কাল্পনিক এবং অবিশ্বাস্য সৈন্যদের দিয়েই আমাকে লড়তে হয়। 

ঋত্বিকঃ তাহলে কী দাঁড়াল? ইতিহাস তো আমাকে ভুল প্রমাণ করে ছাড়ল... আমি ভেবেছিলাম, ভয়ঙ্কর ভাবেই ভেবেছিলাম নদী শুকিয়ে গেলেও সেখানে চর উঠবে... সেখানে ধানক্ষেত হবে। গ্রাম থেকে জেলে মালোরা হারিয়ে গেলেও সে জায়গায় চাষিরা আসবে। কিন্তু আদতে দেখা গেল সভ্যতা একটা জায়গায় গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলল... মানুষের বাচ্চাকে হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে একটা সময় সে নিজেই হারিয়ে গেল। এবার মানুষ কী করবে? সে তো এতদিন সভ্যতার হাত ধরে হাঁটছিল.. কিন্তু সে ব্যাটা তো এবার তাকে ফেলে ভেগেছে..

নবারুণঃ আসলে আমরা দুজনেই বোধয় এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে... আপনি একটা কাল্পনিক চরের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন... আমি কাল্পনিক ফ্যাতাড়ু চোক্তারদের ঠ্যাং ধরে ঝুলছি...

কথোপকথন/২  
বুদ্ধ-রবীন্দ্রনাথ কথোপকথন

‘...আমার এ ধূপ না পোড়ালে... আমার এ দীপ না জ্বালালে...’

বুদ্ধ শ্রাবস্তীর জেতবনে অনাথপিণ্ডিক প্রদত্ত বিহারে অবস্থান করছিলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ গ্রাম্য আবাসে বর্ষা যাপন করে ভদ্রাকপিলানীর অন্তেবাসী ভিক্ষুণীর জ্ঞাতী পুরুষের সাথে শ্রাবস্তীতে ‘আগমন’ করেন। এইখানে উল্লেখ থাকে, ‘আগুন’, ‘গম’ ও ‘মন’ সৃষ্টির এই তিনটি উপাদানকে ‘আগমন’ শব্দটি সেই মুহূর্তে ধারণ করেছিল।

রবীন্দ্রনাথঃ   ‘নহি অভিনন্দি আমি জীবনেরে কিংবা মরণেরে
কালের প্রতীক্ষা করি দাস যথা বেতনের তরে’ 
অনেকদিন থেকেই আমার এই শুরু হয়েছে। আপনকে অনেকদিন হল পর করেছি। এখন আমার মন হয়েছে — যেমন অস্ত যাবার মন। এখন অস্ত যেতেই ইচ্ছে করছে। এখন চাই যেন একবার ঘুমিয়ে পড়ি, আর না উঠি। নির্বিঘ্নে এই আরএনটির আপদ কেটে যাকআমার ইচ্ছে, ছাতিমতলায় আমার বড়দার যেমন হয়েছিল, তেমনিচুপেচাপে শান্তভাবে সব কাজ যেন সারা হয়। তার আগে এসেছি, তথাগত, যাবার আগে শেষবার আপনি সভ্যতার সংকট ব্যাখ্যা করুন... 

বুদ্ধঃ কবি, যা কিছু উদয়ধর্মী তৎসমস্ত বিলয়ধর্মীগভীর এক অরণ্যে দাঁড়িয়ে, হাতে একমুঠ শুকনো পাতা ধরে আমার ভিক্ষু শিষ্যদের বলেছিলাম, তোমাদের আমি যা শিক্ষা দিয়েছি তা আমার হাতের এই পত্রাবলীর ন্যায় সামান্য। আর যা দিইনি তা এই অরণ্যের পত্রাবলীয় ন্যায় বিপুল। 

রবীন্দ্রনাথঃ সেই ছিন্নপত্রাবলীর কথাই বলুন তথাগত...

বুদ্ধঃ নহি আমি ধর্মগুরু, পীর নবী বা অবতার
মন্ত্র জানি না কোনো যাতে সুর তোলে ছেঁড়া তার।।  
বিজ্ঞানও নই, নই কোনো নতুন দর্শন 
পূর্ণ চোখে দেখি শূন্যে ঢেউ ছুটছে কেমন।।    

রবীন্দ্রনাথঃ এই শূন্য অতিক্রান্ত হবে কীভাবে?

বুদ্ধঃ অন্ধে দৃষ্টি বধিরে শ্রবণ 
পদব্রজে যায় ভিখারি শ্রমণ।।   
মানুষ ওঘকে বারণ করেনি কবিযেকোনও সাধারণ অভিধান খুললে সে দেখত স্রোত, তরঙ্গ হল ওঘ। কাম, ভব, দৃষ্টি, অবিদ্যা — বন্যা এই চারপ্রকার। মানুষকে ডুবিয়ে ভাসিয়ে ডুবিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

রবীন্দ্রনাথঃ কী শক্তিতে এই বন্যা সে রুখবে? তার কাছে প্রতিরোধের জন্য কী আছে?

বুদ্ধঃ ভুলটা আমারই। আমি মানুষকে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম। তাই সংকেত, সূত্র দিয়েছিলাম তাকে। ভেবেছিলাম, তার বুদ্ধি দিয়ে সে এই সংকেত থেকে উপপাদ্য সমাধা করবে। হায়, সে শুধু সূত্র মুখস্থ করেছে। যোগ তো একটা সেতু। এক জন্মের সাথে আরেক জন্মের মধ্যে সম্পর্ক যে নির্মাণ করে। শ্রবণ জন্মের সাথে বধির জন্মের সেতু। দৃষ্টি জন্মের সাথে অন্ধ জন্মের সেতু। সেতু তৈরির প্রাথমিক শর্ত, নদীর দুই তীরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়াসে তো অন্ধের দৃষ্টিকে, বধিরের শ্রবণকে স্বীকারই করে না। সেতু দিয়ে, যোগ দিয়ে তার কী হবে। এক জগৎ থেকে আরেক জগতে তার তো চলাচলই হল না, এর নাম নাকি শ্রেষ্ঠ। তার একাগ্রতা নষ্ট হয়ে গেছে।

রবীন্দ্রনাথঃ একাগ্রতা কীভাবে উৎপন্ন হতে পারে?

বুদ্ধঃ তুমি বলো কবি, ইন্দ্রিয় কী?

রবীন্দ্রনাথঃ যা ইন্দ্রত্ব করে, অর্থাৎ আধিপত্য করে, তা-ই ইন্দ্রিয়।

বুদ্ধঃ কিন্তু যদি আধিপত্যের কথাই হয় তবে রূপ অর্থাৎ চোখ, শব্দ অর্থাৎ কান, গন্ধ অর্থাৎ নাক, রস অর্থাৎ জিভ এবং স্পৃশ্য অর্থাৎ ত্বক কখনওই যথার্থ ইন্দ্রিয়ের স্থান পেতে পারে না। এগুলো লৌকিক ইন্দ্রিয়। কিন্তু এগুলোকেই জানানো হচ্ছে মূল ইন্দ্রিয় বলে। নবাগত শিশুকে এটাই শেখাচ্ছে মানুষ।

রবীন্দ্রনাথঃ তবে ইন্দ্রিয় কী তথাগত?

বুদ্ধঃ তার আগে জানা দরকার চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক কেন প্রধান ইন্দ্রিয় নয়। রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, এবং স্পৃশ্য হল পঞ্চ কামগুণ। এই পঞ্চ কামগুণে যে তৃষ্ণা তা-ই কামছন্দ। যা লোভ-চৈতসিক। একাগ্রতার প্রতিপক্ষ এরা। একাগ্রতাকে ধ্যানাঙ্গের আকারে উৎপন্ন হতে দেয় না।

রবীন্দ্রনাথঃ ধ্যানাঙ্গ উৎপন্ন হবে কীভাবে?    

বুদ্ধঃ কোনও বস্তু একাকী উৎপন্ন হয় না কবি। যখন চিত্ত উৎপন্ন হয়, তখন তার সাথে কতগুলি চৈতসিক এবং দৈহিক ক্রিয়া ও অবস্থান্তর উৎপন্ন হয়। রূপোৎপত্তির ক্রম এবং ইতর বিশেষ দেখাবার জন্যই তো জীব ও জগতের শ্রেণিবিভাগ। সেই শ্রেণিতে তাহলে মানুষ আজ কোনখানে এসে দাঁড়াল?   

রবীন্দ্রনাথঃ এই সংকট থেকে সে মুক্তি পেতে পারে না?

বুদ্ধঃ যদি সে সংকটকে চিনতে চায় তবে চিত্ত প্রস্তুত করুক। ইন্দ্রিয় অর্জনে সচেষ্ট হোক। তারপরে তার বিকাশ। চোখ থাকলে তবেই চোখ ফুটবে। 

রবীন্দ্রনাথঃ তবে ইন্দ্রিয়ের স্বরূপ ব্যাখ্যা করুন তথাগত...

বুদ্ধঃ ইন্দ্রিয় বাইশ প্রকার। চক্ষু, শ্রোত্র, ঘ্রাণ, জিহ্বা, কায়, মন, স্ত্রী, পুরুষ, জীবিত, সুখ, দুঃখ, উপেক্ষা, শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধি, প্রজ্ঞা, সুচিন্তা, দুশ্চিন্তা, অজ্ঞাত-জ্ঞাতার্থী, লোকোত্তর জ্ঞানেন্দ্রিয়, লোকত্তর জ্ঞানী ইন্দ্রিয়।

রবীন্দ্রনাথঃ তথাগত, যে জন্মগ্রহণ করে না, সে কি জানে আমি জন্মগ্রহণ করব না?

বুদ্ধঃ জানে। জন্মগ্রহণের যে হেতু, যে প্রত্যয়, সে সেই হেতু সেই প্রত্যয়ের নিবৃত্তি তো জানে। তোমায় একটা গল্প বলি কবি। দেখো তো কিছু বুঝতে পারো কিনা। এক গোপালকের কাছ থেকে এক লোক একঘটি দুধ কিনে পুনরায় তা গোপালকের হাতে দিয়ে চলে গেল। বলল, কাল নিয়ে যাব। পরদিন সেই দুধ দই হয়ে গেছে। সে এসে বলল, আমার দুধের ঘটি দাও। গোপালক দইয়ের ঘটি দিল। লোকটি বলল, আমি তোমার কাছ থেকে দই কিনি নি। আমাকে দুধের ঘটি দাও। গোপালক বলল, আমি ওসব জানি না। তোমার দুধই তো দই হয়েছে। এখন বলো কবি, যদি তারা ঝগড়া করতে করতে তোমার কাছে আসে, তুমি কী ব্যবস্থা নেবে? কিংবা ধরো, এই গল্পটা। এক লোক প্রদীপ জ্বালিয়ে বারান্দায় বসে ভাত খেল। খেয়ে উঠে যাবার পরে প্রদীপ নেবাতে ভুলে গেল। এবার সেই প্রদীপ জ্বলতে জ্বলতে ঘাসে আগুন ধরল। ঘাস থেকে খড়ে। খড় থেকে ঘর জ্বললঘর থেকে সারা গ্রাম জ্বলে গেল। গ্রামবাসীরা লোকটাকে গিয়ে ধরল। কেন তুমি আমাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিলে? সে বলে, আমি তোমাদের গ্রাম জ্বালাই নি। আমি যে প্রদীপে ভোজন করেছিলাম, সে অগ্নি অন্য। আর যে আগুনে গ্রাম জ্বলেছে সে অন্য। উভয়ে বিবাদ করতে করতে তোমার কাছে এল। তুমি কার পক্ষে থাকবে? এবং এ ঘটনার ব্যাখ্যাই বা কী দেবে?

রবীন্দ্রনাথঃ প্রথম গল্পে আমি গোপালকের এবং দ্বিতীয় গল্পে গ্রামবাসীর পক্ষে থাকব তথাগতআর ব্যাখ্যা হল এই, এক শক্তিকে রুখবার জন্য আরেক শক্তি কিছু দেশ ও লোকের হাতে অস্ত্র অর্থাৎ দুধ তুলে দিল। তাতে তার বিপুল অর্থ সমাগমও হল। মানে ওই প্রদীপ জ্বালিয়ে ভোজন। এখন সেই অস্ত্র অর্থাৎ দুগ্ধ দধি হয়ে গেছে। না নেবানো প্রদীপ থেকে গ্রাম জ্বলে গেছে। অস্ত্রদাতা শক্তি বলছে, যে অস্ত্র আমি তোমাকে দিয়েছিলুম সে অন্য। আর যে অস্ত্র এখন তুমি চালাচ্ছ সে অন্য। 

বুদ্ধঃ তবে এও ঠিক, আমি যেমন বলেছিলাম, আমি জেনেই ধর্মদেশনা করছি। না জেনে নয়। তেমনি এও তো বলেছিলাম, সঙ্ঘ যদি ইচ্ছা করে আমার অবর্তমানে ক্ষুদ্রানুক্ষুদ্র শিক্ষাপদসমূহ ধ্বংস করুক। বুদ্ধিমান মানুষ ধ্বংসে কোনও কার্পণ্য করেনি।  

রবীন্দ্রনাথঃ সত্যি তবে কী তথাগত? এই ‘না’টাকেই, এই মিথ্যেকেই আমরা সত্যি বলি, যখন সেই সত্যিই আবার মিথ্যে হয়ে যায়। এ কতো বড় ইন্দ্রজালএত লিখেছি, এত কথা বলেছি জীবনে যে লজ্জা হয় আমার। এত লেখা উচিত হয় নি। এটা অসভ্যতা। অনেক আগেই এর শেষ হওয়া উচিত ছিল। সে কহে বিস্তর মিছা, যে কহে বিস্তর। যা বলেছি, যা বলি তার কতটুকু সত্যি? কিছুই যেন সত্যি নয়। ছেলেবেলায় যে সুখদুঃখ পেয়েছি, তখনকার মতো সত্যি আর কিছুই ছিল না। আজ মনে হচ্ছে তার মতো মিথ্যে আর কিছুই নয়। ছায়ার ছায়া হয়েও তো সে থাকে না। একদিন যে পাত পেড়ে খেয়েছিলুম, তার কোনও চিহ্ন কোথাও নেই।

বুদ্ধঃ সত্য প্রত্যেকটির মধ্যেই আছে রবীন্দ্রনাথ। প্রদীপের শিখার সমগ্রতা যেমন সত্য, তেমনি শিখার প্রথম থেকে শেষ অবধি প্রতিটি কণার অংশও সত্য। একটা গৃহ যেমন সত্য। গৃহের প্রতিটি ইঁটও সত্য। ইঁটের সত্য আর গৃহের সত্য আলাদা। কিন্তু বিচ্ছেদ্য নয়। শিখার একটি কণা তার পরের কণাটির কাছে নিজের শক্তি হস্তান্তর করে। এটাই জন্ম। এটাই জন্মান্তর। কোটি কোটি জন্ম, মৃত্যু আর জন্মান্তর নিয়েই একটা গোটা জীবন।

পরিশেষে, রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধকে বলেন, ‘‘চলুন, ভবিষ্যতে ফিরে যাই’’। কল্পনাপ্রবণ কবির ভ্রম শুধরে দেন তথাগত। ‘‘ভবিষ্যতে কীভাবে যাবে। মোহাচ্ছন্ন প্রাণ শুধু তার জন্য অপেক্ষাই করে যায়, দাস যথা বেতনের তরেতবে, একটা ভবিষ্যতে যাওয়াই যায়। আজ যেটা ইতিহাস একদিন সেটা ভবিষ্যৎ ছিল। এই ভবিষ্যতে আমরা যেতে পারি আমাদের অসম্পূর্ণ শিক্ষা সম্পূর্ণ করার জন্য’’।  

(চলবে)
 

No comments:

Post a Comment