।। ২য় পর্ব ।।
নিজস্ব
ভাষায় আঁকি আলপনা, শিল্পে শস্যে সাজাই সংসার
তখন ভাষা আন্দোলনে
উত্তাল সারা মানভূম। বাংলাভাষী
মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দি। চারদিকে
অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। আজকের এই পুরুলিয়া জেলা তখন অবিভক্ত মানভূম হিসেবে বিহারের
অন্তর্গত ছিল। পৃথিবীতে যতগুলো ভাষা আন্দোলন হয়েছে
একুশে ফেব্রুয়ারি বা উনিশে মে থেকে
আরম্ভ করে বিভিন্ন দেশে নিজস্ব ভাষাগত অধিকারের দাবি নিয়ে মানভুমের ভাষা আন্দোলন তাদের মধ্যে দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন । বাবার কথা
লিখতে হলে তাঁর কবিজীবনের প্রাথমিক পর্ব
সম্পর্কে আলোকপাত করতে হলে এই
সূচনাবিন্দুটিকে বলা খুব দরকার। যেহেতু ভাষা আন্দোলনই তাঁর কবিজীবনের
অঙ্কুরোদগমে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল তাই একটু বিস্তারিতভাবে এর প্রেক্ষিত বলে নিতে হবে। মানভূমের ৮৭ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা হওয়া
সত্ত্বেও হিন্দীকে সেদিন বাধ্যতামূলকভাবে প্রথম ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয় । মানভুমের প্রতিটি স্কুলে
পড়ানোর মাধ্যম হয়ে ওঠে হিন্দি । যে সমস্ত স্কুল শিক্ষকেরা হিন্দিকে আবশ্যিক ভাষা
হিসেবে পড়াতে শুরু করেন তাঁদের উৎসাহিত
করা হয় ট্রেনিং দিয়ে এবং বেতন বাড়িয়ে ।
অন্যদিকে যাঁরা সেদিন সরকারের এই নীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন প্রতিবাদে। যাঁরা নিজেদের
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য সর্বস্ব পণ
করেছিলেন এবং নিজেদের যাবতীয় সুখ
স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন শাসকের চক্ষুশূল।
১৯৩৫ সালে ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের
সভাপতিত্বে মানভুম বিহারী সমিতির
আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরই প্রতিরোধক
ভূমিকা নেয় পুরুলিয়ার ব্যারিস্টার পি আর
দাসের নেতৃত্বে মানভুম বাঙালী সমিতি।
স্বাধীন ভারতবর্ষে বিহার সরকারের
প্ররচনয়ায় এবং উস্কানিতে মানভুমের সর্বত্র
হিন্দির প্রচার এবং প্রসার ঘটতে থাকে। ১৯৪৮ সালের এক সরকারি বিজ্ঞতিতে একথা বলা
হয় মানভুম জেলার কোন স্কুলের
সাইনবোর্ডে বাংলা লেখা চলবে না তা দেবনাগরী হরফে লিখতে হবে। আবশ্যিক ভাবে
বিদ্যালয়ের প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে কোন বাংলা গান গাওয়া যাবে না, রামধুন সঙ্গীত
গাইতেই হবে। সরকারি অফিসের কাজকর্ম হবে হিন্দিতে । বাংলায় লেখা দরখাস্ত গ্রাহ্য
হবে না। জেলার সর্বত্র দেওয়ালে বিজ্ঞাপিত হতে থাকে - মানভুম বাঙ্গাল মে নেহি জায়েঙ্গে, আগর জায়েঙ্গে
তো খুন কা নদী বহা দেঙ্গে। তামাম জেলা জুড়ে এক সন্ত্রাসের বিভীষিকা নেমে আসে। আমার দাদু রাখহরি গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন পেশায় শিক্ষক। সাঁতুড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তখন তিনি কর্মরত। অন্যন্য স্কুলের
মতো বিহার সরকারের নির্দেশ গেল সেই স্কুলেও – বাংলা ভাষা পড়ানো চলবে না। হিন্দি ভাষার মাধ্যমে স্কুলের
যাবতীয় পঠন পাঠন করতে হবে। যে সমস্ত শিক্ষক সরকারি এই নির্দেশ অমান্য করবেন তাদের
বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাঁরা হিন্দি জানেন না বা যাদের হিন্দিতে
সেরকম দক্ষতা নেই প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তাঁদের উপযুক্ত করে তোলা হবে এবং প্রশিক্ষন শেষে তাঁদের অতিরিক্ত ভাতা এবং
ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হবে। সারা জেলায় অনেক শিক্ষক শিক্ষিকা এবং সরকারি কর্মচারী
সেদিন সরকারের এই নির্দেশিকা মেনে নিলেও অল্পসংখ্যক শিক্ষক শিক্ষিকা যাঁরা এই কালা
আদেশ মেনে নিতে পারেন নি আমার দাদু তাঁদের মধ্য অন্যতম। সরকারি এই ফরমানের
বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন এবং ছাত্রদের বলেছিলেন – আমার শেষ রক্তবিন্দু
দিয়েও আমি বাংলা পড়িয়ে যাব।
সরকারের
হাত অনেক লম্বা। তাই আইন চুপচাপ বসে
থাকেনি। স্কুল পরিদর্শক বিদ্যালয় পরিদর্শনে এসে বলেছিলেন – আপনি সরকারের নির্দেশ অমান্য করেন কোন সাহসে?
সাহস এটাই
যে আমি একজন বাঙালী ।
আপনি কি
লোকসেবক সঙ্ঘের প্রচারক?
না কারো
প্রচারক বা সমর্থক নই, আমার মাতৃভাষার
মর্যাদা রক্ষার জন্য আমি যেকোন মূল্য দিতে প্রস্তুত।
নিজে সরকারি
নির্দেশ মানছেন না ঠিক আছে, কিন্তু যারা
যে সমস্ত বাঙালী শিক্ষক সরকারের নির্দেশ মেনে স্কুলে হিন্দি পড়াচ্ছেন
তাদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করছেন কেন ?
তাদের
মেরুদণ্ড নিয়ে আমার সন্দেহ আছে বলে । মান সম্মান বোধ নিয়েও সংশয় আছে । দুপয়সা বেতন
বেশি পাওয়ার লোভে তারা যা করছে এতে আমার নিজেরই মাথা নুয়ে যাচ্ছে।
তাহলে আপনি
কি স্কুলে হিন্দি পড়াবেন না ? এটাই আপনার শেষ কথা?
হ্যাঁ।
সরকার
বিরোধী এই অবস্থানের জন্য দু-বছর বেতন বন্ধ
হয়েছিল দাদুর। বাড়িতে তখন চরম আর্থিক সংকট। জমি জায়গাও তো তেমন বিশেষ ছিল না। বাবা কাকু
জেঠুমনি ও আমার পিসিমনিরা মিলে ছ ভাইবোন। এর সাথে আরও দুজন জেঠু (বাবার পিসতুতো ভাই )। সবমিলিয়ে বেশ বড়
সংসার। দাদুকে খুব চিন্তিত লাগত সবসময়। একদিন পায়চারি করতে করতে বাবাকে জিজ্ঞেস
করলেন – হ্যাঁ রে মোহিনী, আমি কিছু ভুল
করিনি তো?
এরকম ভাবছ
কেন? তোমার জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। একবেলা না খেলে আমরা তো মরে যাচ্ছি না ।
কিন্তু এই নিজেদের ভাষাই
যদি মরে যায় তাহলে আমরা বাঁচব কী করে?
এই
ঐতিহ্যের উত্তরসূরি হিসেবে বাবাকেও তাই মানভুমের ভাষা আন্দোলন অনেকাংশে প্রভাবিত
করেছিল। পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই এবং বাবার লেখালেখির জগতে আসার প্রারম্ভিক পর্বেই
নিজস্ব ভূখণ্ডের নিজস্ব ভাষার এই বিপন্নতা তাকে অস্থির করে তুলেছিল।
ঘরে বাইরে তখন
উত্তাল সারা মানভুম – শুন বিহারী ভাই/ তরা
রাইখতে লারবি ডাং দেখ্যাই / তরা আপন পরে ভেদ বাড়ালি / বাংলা ভাষায় দিলি ছাই / ভাইকে ভুইল্যে করলি বড় বাংলা – বিহার বুদ্ধিটাই/
বাঙালি বিহারী সবই এক ভারতের আপন ভাই / কনহ ভেদের কথা নাই / এক ভারতে ভাইয়ে ভাইয়ে
মাতৃভাষার রাজ্য চাই। মাতৃভাষার অধিকার
হরণকে মেনে নিতে পারেনি বাবার শিশুমন। অধিকার হরণের নামে এ কোন স্বাধীনতা? এই
প্রশ্ন এবং জিজ্ঞাসা নিয়েই লিখিত হয়েছিল তার প্রথমপর্বের কিছু কবিতা। হয়তো নতুন হাতের লেখা বলেই আবেগ
প্রবণতা থেকে নিস্তার পায়নি সেই সেইসব কবিতা। কিন্তু আবেগ আর তেজস্বীতাই হয়ে
উঠেছিল তাঁর ভিত্তিপ্রস্তর। মোহিনীমোহন গাঙ্গুলী
নামেই বাবা তখন লিখতেন। বাবার প্রাথমিক
পর্বের কবিতাগুলি এবং কেতকীর বেশকিছু সংখ্যায় মোহিনী মোহন গাঙ্গুলী নাম
এখনও জ্বলজ্বল করছে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাবা গঙ্গোপাধ্যায় পদবীর
ব্যবহার শুরু করে। এই প্রসঙ্গে পরে আসব।
মানভুমের
ভাষা আন্দোলনই যেহেতু বাবার হাতে কলম তুলে নেওয়ার এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত। ফলে তাঁর
কবিতার মধ্যে মানুষের আন্দোলন, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়েয় দুর্জয় প্রস্তুতি এবং
মানবতার সপক্ষে ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কাব্যিক বিস্ফোরণ এবং এর ফলেই কমিটেড, সামাজিক
দায়বদ্ধ কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু যাঁরা খুব গভীরভাবে মোহিনীমোহন পড়েছেন তাঁরা জানেন শুধু
সোচ্চার কবিতা নয় রোম্যান্টিক এবং নিরুচ্চার কবিতার ক্ষেত্রেও একটি নিজস্ব বিচ্ছুরণ বলয় তৈরি করেছেন বাবা। জীবনের
টানাপড়েন ঘাতপ্রতিঘাত আর রক্তাক্ত দুঃসময়ও
তাঁর কবিতার রোমান্টিক সত্তাকে বা চৈতন্যের বিচ্ছুরণকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। লোভ আর লাভের বিকারে বেড়ে
ওঠা এই সমাজের ভেতর তিনি মানবমুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন প্রেমে ও সংগ্রামে।
জরুরি। ইতিহাস।
ReplyDelete