বাক্‌ ১১৫ ।। এ মাসের কবি ।। মুজিব ইরম





মুজিব ইরম-এর জন্ম বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার নালিহুরী গ্রামে, পারিবারিক সূত্র মতে ১৯৬৯, সনদপত্রে ১৯৭১।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান ১৯৯৬, ইরমকথা ১৯৯৯, ইরমকথার পরের কথা ২০০১, ইতা আমি লিখে রাখি ২০০৫, উত্তরবিরহচরিত ২০০৬, সাং নালিহুরী ২০০৭, শ্রী ২০০৮, আদিপুস্তক ২০১০, লালবই ২০১১, নির্ণয় জানি ২০১২, কবিবংশ ২০১৪, শ্রীহট্টকীর্তন ২০১৬, চম্পূকাব্য ২০১৭। উপন্যাস/আউটবই: বারকি ২০১১, মায়াপীর ২০০৯, বাগিচাবাজার ২০১৫। গল্পগ্রন্থ: বাওফোটা ২০১৫। শিশুসাহিত্য: এক যে ছিলো শীত অন্যান্য গপ ২০১৬। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস: জয় বাংলা ২০১৭। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে ধ্রুবপদ থেকে মুজিব ইরম প্রণীত কবিতাসংগ্রহ: ইরমসংহিতা ২০১৩, বাংলা একাডেমি থেকে নির্বাচিত কবিতার বই: ভাইবে মুজিব ইরম বলে ২০১৩, Antivirus Publications, Liverpool, England থেকে নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ: Poems of Mujib Erom 2014, ধ্রুবপদ থেকে উপন্যাসসমগ্র: মুজিব ইরম প্রণীত আউটবই সংগ্রহ ২০১৬।

পুরস্কার: মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান-এর জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৬। বাংলা কবিতায় সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছেন সংহতি সাহিত্য পদক ২০০৯, কবি দিলওয়ার সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪। কবিবংশ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪। শ্রীহট্টকীর্তন কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬


।। মুজিব ইরমের কবিতা ।।

বন্দনা

প্রথমে বন্দনা করি গ্রাম নালিহুরী। ছাড়িয়াছি তার মায়া যেন কাটাঘুড়ি \ পরেতে বন্দনা করি আকাশ পাতাল। পিতামাতা দেশ ছাড়া হয়েছি মাতাল \ পুবেতে বন্দনা করি নাম তার মনু। এমনি নদীর রূপ উছলে ওঠা তনু \ উত্তরে বন্দনা করি শ্রীহট্ট নগর। সে তো থাকে মন মাঝে অনন্ত অনড় \ পশ্চিমে বন্দনা করি লেখাবিল নাম। -জীবন তার তরে তুলেছি নিলাম \ দক্ষিণে বন্দনা করি নাম শ্রীমঙ্গল। দেখিয়াছি টিলারূপ কুহকী জঙ্গল \ মৌলভীবাজার-কথা কী কহিবো আর। সে তো জানি প্রাণসখা বন্দনা অপার \ চারদিক বন্দি শেষে মন করি স্থির। ধরিয়াছে এই দেহ দেশের জিকির \ বন্দনা করিয়া সারা মধ্যে করি ভর। আসো গো কবির সখা বৈদেশ নগর \ ভিনবাসে ঘুরিফিরি তিষ্ঠ ক্ষণকাল। পয়ারে মজেছে মন বাসনা বেহাল \ পদ্য বাঁধি গদ্য বাঁধি সুরকানা আমি। ইরম হয়েছে ফানা জানে অন্তর্যামী \


কবিবংশ

আদিপুস্তকোত্তর ১লা কুলজি

লিখিয়াছি কবিবংশ আদি সে-কিতাব, তবুও তো ধরে রাখি অতৃপ্তি অভাব। বংশ বংশ করি বেশ কেটে গেলো কাল, রক্তে জাগে সেই ভাষা যাবনী মিশাল। শ্রীকর নন্দীর বাণী দেশী ভাষা কহে, কবি শেখর -বংশে লৌকিক বিছারে। বঙ্গবাণী নাম ধরি আব্দুল হাকিম, ভাষাবংশে আদিগুরু আমি সে তো হীন। কী প্রকারে তার নামে প্রণামিব হায়, আতারে-পাতারে খুঁজি মনে জুয়ায়। সেই তো হয়েছে শুরু আমাদের দিন, ভুসুকুপা তস্য গুরু বাঙ্গালী প্রাচীন। আরো এক বংশবাতি সগীরের নামে, বৃন্দাবন দাস নমি চৈতন্য প্রচারে। বড়ুচণ্ডীদাস ভনে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মুকুন্দ রামের নামে পরাই চন্দন। রামাই পণ্ডিত রচে পাঁচালি সঙ্গীত, প্রভুর চরণে মজে নিজ মত্ত চিত। সেই যে বাঁধিল গীত কানা হরিদত্ত, -মূর্খ রচিবে কী যে ভবেতে প্রমত্ত। বিজয় গুপ্তের নামে বংশবাতি পায়, ইরম মাগিছে দয়া বংশগরিমায়।

পরিশিষ্ট প্রণাম: প্রণামে-সুনামে গড়ি শব্দ-বাক্য-মিথ, পয়ারে-খেয়ালে শুধু গাই বংশগীত। অন্ধকার যুগে বাঁধি গয়েবি কামোদ, পটমঞ্জরীতে সঁপি সেই সুদবোধ। আমি যে বাঁধিবো তাল কুলিন রাগিনী, ভূর্জপত্রে নতজানু দয়া কী মাগিনী! তুমি কন্যা বেঁধো সুর মর্জি যদি হয়, এই বংশে জেগে থাকে চর্যাবিনিশ্চয়।


কবিবংশ

২য় সর্বশেষ কুলজি

সেই কবে ভাববশে ভুলিয়াছি ধাম, বিপ্রদাশ পিপিলাই ধরিয়াছি নাম। জয়দেব হয়ে রচি গোবিন্দের গীত, ছিটিয়েছি পুষ্পঢেউ কামের কিরিচ। রচিয়াছি চম্পূকাব্য কোনো এক কালে, বন্দনা করেছি কতো আনে আর বানে। আমিও শ্রীহট্টে জন্মে রাধারূপ ধরি, কবেই ছেড়েছি বাড়ি শব্দ শব্দ জপি। জৈন্তা পাহাড়ে ইরম দেখিয়াছি রূপ, বামেতে বন্ধুবাড়ি ডানেতে অসুখ। তবুও আলোর ডাক তবুও স্বপন, শ্রীহট্টে জন্মিয়া ভ্রমি বিস্তীর্ণ ভুবন। রচিতে প্রেমের শ্লোক তুচ্ছ করি কাম, বলেছি সহস্র বার নারীকে প্রণাম। জমিয়েছি দূরবাসে একজন্ম ঋণ, অকূল পাথারে ভাসি দলহারা মীন। সন্ধ্যাভাষা ভুলি নাই গুহ্য অন্তমিল, আমারও রক্তে ছোটে চর্যার হরিণ।

মোনাজাত: তুমি পুত্র কবিবংশের লোক...ধরিও বংশের খুঁটিÑ জন্মভিটা যেন আর না থাকে বিরান। তোমার তরিকা যেন সত্য হয় প্রেমÑ দি¦ধাহীন করে যেও বংশের বয়ান...পুত্র তুমি, পিতা তুমি, তুমি বংশের মানÑ তোমাকে স্বাগত বলি, জানাই সেলাম!


ইতিবৃত্ত: পূর্বাংশ

তুমি কোন মুল্লুকের মৌলভী গো? তোমার আলখাল্লায় লেগে আছে সিঁদুরের দাগ, তোমার সফেদ পাঞ্জাবীতে ধূপধুনি আতরের ঘ্রাণ, তোমার গলায় ওঠে কীর্তন জিকির, তুমিও পীরের দেশে পীর হয়ে কাটিয়েছো দিন, তুমিও বৈষ্ণব হয়ে বৈষ্ণবীর খুঁজে গাঁয়ে গাঁয়ে গেয়ে গেছো বেদনার গীত, তুমি দেখি ধরে আছো নানা কিসিমের বেশ, নানা উপাধি, তুমি কি গো এই গাঁয়ে পরদেশী পীর? পরদেশী সন্নাসী ফকির? তোমার দোতারা কার ইবাদতি করে গো হযরত? তোমার তসবিদানা কোন মন্ত্র জপে? মন্দির মসজিদে তুমি করো যাতায়াত, আজান উলুধ্বনি একি কণ্ঠে ধরো, কোন দেশের মুসল্লি গো তুমি? তোমার দেশের নদী ধরে বুঝি আল্লার জিকির, ধরে বুঝি দেবতার স্তুতি?

তোমাকে দেখেই আমি বুঝে গেছিÑ এক এমনি দেশ, এমনি তার রীতি, একই নদী ভরে ওঠে পানি জলেতে, এক জলসা রাঙ্গা হয় আদাবে সালামে!


রোল কল

: মুজিব ইরম? : উপস্থিত!

কে আমারে ডাক পাড়ে, কে আমারে নাম ধরে রোল কল করে? আমি তো পরীক্ষা ফেল, লাস্টবেঞ্চ, দেরি করা লোক...রেজিস্টারে কাটা নাম কেনো তবে বারবার উচ্চারিত হয়, কেনো তবে বারবার মনে পড়ে রোল নং, অস্তিত্ব আমার! এত যে তুলেছি হাত, দূর থেকে, এত যে বাড়াই গলাÑ আছি, তুমি কি শুনিতে পাও ওহে শিক্ষিকা আমার?

আমি তো আউট পড়া লোক, সেই কবে রোল নং ভুল করিয়াছি, হাজিরা খাতার নাম ভুল করিয়াছি।


জাতক

কতো না ঘুরেছি পথ ছদ্মবেশে, দেশে দেশে, নগরে নগরে...এই ভেক, এই মিছা আবরণ খুলে ফেলো...এই নামে ডাকো তুমি ডাকিবার ইচ্ছা যদি হয়...তুমি তো ডেকেছো কতো মায়াময় নামে...কতো রূপে হয়েছি হাজির...কতো নামে সাড়া দিতে হয়েছি অধীর...আমাকেও ডাকো তুমি নকলী অভিধায়...মনে লজ্জা পাই...আমাকেও দেখে কেউ বাস করি বৈদেশ নগর...আমাকেও দেয় খোঁটাÑ সোনা ছেড়ে খাদ বাছি, ছেড়ে আসি বাস্তুভিটা, ছেড়ে আসি ঘর...এত এত ডাকনাম, এত এত রূপে ডাকাডাকি...ইতা আমি লিখে রাখি তেমনি আবারÑআর কোনো নাম নাই লেখা এই বুকে, আমিও সিলট্যা লোক জানে সর্বলোকে!


বৈদেশী

হঠাৎ টুটেছে নিদ্রা রাত্রি কতো দূর, নিজেই পেঁতেছি ফাঁদ নিজেই বিভোর। যদি না কপাল ফাটা রেজারতি রয়, নিজ দেশ রাখি বুঝি পরদেশী হয়! পরবাসী পরবাসী কান্দে তনুমন, হেলায় ভুলেছো পথ কহে গুরুজন। এমত বংশের লোক ডেকে কয় ওরে, যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে! আমি কী ফিরিবো আর নাই কোনো পথ, উজাইয়ের মাছ আমি পুষেছি অপথ!

কুক্ষণে ধরেছি মায়া বিদেশ বিভ্রম, পয়ার প্রবন্ধ রচে মুজিব ইরম।


লীলাসূত্র

শব্দ বড়ো যাদু জানে যাদু জানে গো!

দিবস-রজনী আমি ফানা হয়ে থাকি। আসবে বলে আমার কুঞ্জে কান্না ফেরি করি। নৌকাবিলাসে হঠাৎ মত্ত হয়ে দেখি, বিরহে কেটেছে দিন শব্দ শব্দ জপি! আর কি হবে না নদী জলে টলমল? আর কি হবে না লীলা বন্ধু-সহচর? তাহাকে দেখিতে মন রজনী পোহায়, না-জানি কার কুঞ্জে থেকে আমাকে কাঁদায়!

তোমাকেই নিত্য জপে নির্ধনিয়ার ধন, ইরম করিছে সঙ্গি রজনী-রোদন।


মনোবাস

মনোবাসে আছি আমি মনোবাসে আছি, অজানা ¯্রােতের টানে নাই হয়ে বাঁচি \ দেশছাড়া খেশছাড়া ভিনবাসী মন, হারানো মানুষ আমি করহ যতন \ পাঁচবেলা মজে থাকি জপি প্রেমনাম, নিন্দুকেরা দেখে শুধু দেহভরা কাম \ ইবাদতি করি মনে নিত্যানন্দ থাকি, দেখিয়া অনেক ছায়া এই কায়া আঁকি \ কাছে থাকি পাশে থাকি বাওসারা লোক, আমার হয়েছে দেখো মায়ার অসুখ \ তুমিও রাখিও কাছে রাগঅনুরাগে, আমাকে বাঁধিও তুমি মালকোশ রাগে \ ভাবঘোরে ঘিরে রেখো যতো ভুলচুক, ইরম করিছে দাবি এই মায়া হোক \


আমার নাম মুজিব ইরম
আমি একটি কবিতা বলবো

এঁকে রাখি পাখি। ফুলপাতা বাকি। তুলে আনি গাছ। চিরচেনা মাছ। জলে ভাসা ফুল। গন্ধ বকুল। মাঠে মাঠে হাওয়া। সুর খুঁজে পাওয়া। গাছে গাছে ফল। ডাকিছে সকল। ডাকে প্রিয় খেলা। সেই হুরুবেলা। আছি এত দূরে! ডাকি সুরে সুরে। মনে রেখো দেশ। ভাই বন্ধু খেশ। তোমাদের মায়া। স্নেহ ভরা ছায়া। জপি দমে দম। মুজিব ইরম।

6 comments:

  1. বাকবিরোধী বাক মনে হল। অ্যাক্সিdent(?)...

    ReplyDelete
  2. থিতিয়ে যাচ্ছে এক তীব্র জারক। উপলব্ধি এমন ভাষাহীন করে দিচ্ছে যে এক দুর্জয় ঘোরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছি।

    ReplyDelete
  3. দারুণ, দারুণ
    খুব ভালো লাগা

    ReplyDelete
  4. দারুণ, দারুণ
    খুব ভালো লাগা

    ReplyDelete
  5. পাগল হয়ে গেলাম পড়ে। এই রোমাঞ্চ ভাষায় লিখতে অপারগ। বাক্‌ কে ধন্যবাদ। কবিকে সালাম। অনেক অনেক দিন পর আমি কবিতা পড়ে ধন্য হলাম।

    ReplyDelete